বুধবার, ১৬ নভেম্বর, ২০১৬

আর রাহীকুল মাখতূম



‘আর রাহীকুল মাখতূম’ একটি সীরাত গ্রন্থ। আল্লামা ছফিউর রহমান মোবারকপুরী (রহ.) আরবি ভাষায় এ গ্রন্থটি রচনা করেন, যা যুগের সেরা সিরাত গ্রন্থ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। এ গ্রন্থটি মূলত সিরাত এর ওপর রচিত অতীতের শত শত গ্রন্থের মৌলিক ও নির্ভরযোগ্য উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত। এক কথায় সিরাত সংক্রান্ত বিশাল সংগ্রহশালার একটি নির্যাস গ্রন্থ।
বিশ্বমানবতার মুক্তির দূত, সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও রাসুলকে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনই উচ্চ মর্যাদা দান করেছেন। যিনি স্বয়ং তাঁর ফেরেশতাদের নিয়ে রাসুলের নামে দরুদ ও সালাম পাঠান। তিনিই তাঁর প্রিয় রাসুলকে ভালোবাসার জন্য আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন। রাসুলের আনুগত্যের মাধ্যমেই মহান আল্লাহ তায়ালাকে ভালোবাসার প্রমাণ এবং মানুষের ইহকালীন ও পরকালীন মুক্তি বলে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কোরআনুল কারিমে ঘোষণা দিয়েছেন।

রাসুলের সুন্নাহ হচ্ছে এক জীবন্ত ও সর্বোত্তম আদর্শ। কেয়ামত পর্যন্ত এ আদর্শের আবেদন, এ আদর্শের বর্ণনা এবং এ আদর্শ সম্পর্কে গ্রন্থ রচনা অব্যাহত থাকবে। কারণ, রাসুলের আদর্শের মাঝে রয়েছে মানুষের জন্য হেদায়েতের আলো। আল্লাহর রাসুলের কাজ ও চরিত্রই হচ্ছে তাঁর সিরাত। কোরআনের প্রতিচ্ছবি, সব মানুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ও পরিপূর্ণ, সমগ্র মাখলুকের ভালোবাসা পাওয়ার উপযুক্ত এমন মহান ব্যক্তিত্বের প্রতি যুগে যুগে মুসলিমরা ভালোবাসার প্রমাণ দিয়ে এসেছে। তারই ধারাবাহিকতায় হিজরী ১৩৯৬ সনে রাবেতায়ে আ’লমে ইসলামী সীরাতুন্নবী (সা) সম্পর্কিত গ্রন্থ রচনা প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। বিশ্বব্যাপী এ প্রতিযোগিতায় বিভিন্ন দেশের বহু লেখক আগ্রহসহ অংশগ্রহণ করেন। ১১৮২টি পাণ্ডুলিপির মধ্যে ‘আর রাহীকুল মাখতূম’ গ্রন্থটিকে প্রথম পুরস্কার প্রদানের মাধ্যমে এক বিরল সম্মানে ভূষিত করা হয়েছে। আর এ দুর্লভ সম্মানের কৃতিত্ব, অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তার সমস্ত প্রশংসা শুধুমাত্র তাঁরই প্রাপ্য যাঁর আদর্শকে কেন্দ্র করে এ গ্রন্থ রচিত হয়েছে।
সাহিত্যকর্মের রূপ-রস, সৌন্দর্য, মাধুর্য, শোভনতা, সাবলীল ও প্রাঞ্জলতার মধ্যেই নিহিত রয়েছে উক্ত সাহিত্যকর্মের প্রকৃত মূল্য। ‘আর রাহীকুল মাখতূম’ গ্রন্থের সুন্দর ও সাবলীল প্রকাশভঙ্গি এবং লেখকের মোহনীয় শক্তি জায়গা করে নিয়েছে বিশ্বে কোটি কোটি মানুষের অন্তরে। পাঠকের কথা বিবেচনায় রেখে লেখক গ্রন্থ রচনার ক্ষেত্রে গ্রন্থের কলেবর অস্বাভাবিক দীর্ঘ করেননি, আবার খুব বেশি সংক্ষিপ্তও করেননি। অথচ এটি একটি পূর্ণাঙ্গ সিরাত গ্রন্থও বটে।
গ্রন্থ রচনায় লেখক ঐতিহাসিক ঘটনাগুলোর ধারাবাহিক বর্ণনা করেছেন এবং সেগুলোর বর্ণনায় তিনি বিভিন্ন অধ্যায়ের শিরোনাম দিয়ে পর্যায়ক্রমিকভাবে বিন্যস্ত করেছেন। যেসব ঘটনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন গ্রন্থে মতপার্থক্য রয়েছে সেসব ক্ষেত্রে লেখক সবকিছু পর্যালোচনা করে যেটি সঠিক মনে করেছেন সেটির উল্লেখ করেছেন। যেসব ক্ষেত্রে ভিন্ন মত পোষণকারীদের তথ্য লেখকের কাছে সঠিক মনে হয়নি সেসব ক্ষেত্রে তিনি যুক্তি-প্রমাণের ইঙ্গিত প্রদান করেছেন। আবার, তথ্যের উৎস হিসেবে গ্রন্থটিতে লেখক অসংখ্য গ্রন্থের নাম ও পৃষ্ঠা নম্বর উল্লেখ করেছেন।
গ্রন্থের শুরুতে লেখক রাসুল (সা.) এর আবির্ভাবের আগে পৃথিবীতে বিরাজমান বিভিন্ন অবস্থা ও পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করেছেন। আরবের ভৌগোলিক পরিচয়, তৎকালীন সময়ে বিভিন্ন জাতির অবস্থান, আরবের নেতৃত্ব ও শাসন ব্যবস্থা, আরবদের ধর্মীয় বিশ্বাস ও মতবাদ, জাহেলি সমাজের চারিত্রিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার চিত্রাঙ্কনের মাধ্যমে লেখক এ পৃথিবীতে রাসুল (সা.) এর আবির্ভাবের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অত্যন্ত সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। অতঃপর রাসুল (সা.) এর পবিত্র ও সংগ্রামী জীবনের প্রতিচ্ছবির এক অনবদ্য উপস্থাপনা গ্রন্থটিকে করেছে প্রাণবন্ত।
রাসুল (সা.) এর দাওয়াতের বিভিন্ন কৌশল ও পর্যায় বর্ণনা হতে শুরু করে, বদর, ওহুদসহ বিভিন্ন যুদ্ধ, মক্কা বিজয়, বিদায় হজ, রাসুল (সা.) এর ওফাত পর্যন্ত সব ঐতিহাসিক ঘটনা বর্ণনার পর রাসুল (সা.) এর পরিবারের পরিচিতি, রাসুল (সা.) এর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও শারীরিক সৌন্দর্য বর্ণনার এক ব্যতিক্রমী উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে লেখক গ্রন্থটির পরিসমাপ্তি টানেন।
‘আর রাহীকুল মাখতূম’ গ্রন্থটির বিশ্বব্যাপী আলোচিত ও প্রশংসিত হওয়া এবং অস্বাভাবিক জনপ্রিয়তার কথা বিবেচনা করে খাদিজা আখতার রেজায়ী বাংলা ভাষাভাষীদের জন্য গ্রন্থটির সর্বপ্রথম বাংলা অনুবাদ করেছেন। অনুবাদ গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে আল কোরআন একাডেমি। পরবর্তীতে তাওহীদ পাবলিকেশন্স, পিস পাবলিকেশনসহ অনেকেই গ্রন্থটির বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করেছে।

সাঈদুর রহমান
প্রথম প্রকাশ: সভ্যতা ও সংস্কৃতি, আলোকিত বাংলাদেশ
(২৪ অক্টোবর ২০১৬)

1 টি মন্তব্য: