মঙ্গলবার, ৬ জুন, ২০১৭

মা-যা খাসিরাল আ’লামু বিনহিতাতিল মুসলিমীন

উপমহাদেশের খ্যাতনামা আলিম, লেখক, চিন্তাবিদ ও বুযুর্গ সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী (র) কর্তৃক ''মা-যা খাসিরাল আ'লামু বিনহিতাতিল মুসলিমীন'' আরবী ভাষায় রচিত বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টিকারী চিন্তাসমৃদ্ধ অনবদ্য একটি গ্রন্থ। এ গ্রন্থে লেখক মুসলমানদের উত্থান ও পতনে বিশ্বে কী প্রভাব পড়েছে তার ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ, অধঃপতনের কারণ, কিভাবে তারা আবার বিশ্ব নেতৃত্ব ফিরে পেতে পারে এ ব্যাপারে মুসলমানদের দায়িত্ব ও কর্তব্য কী তার সঠিক দিক-নির্দেশনা এবং মুসলিমদের উত্থান আবারও পুরো মানবজাতির জন্য কেন গুরুত্বপূর্ণ তা অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় উপস্থাপন করেছেন।

পৃথিবীর বুকে মুসলমানদের উত্থান তথা ইসলামী বিপ্লবের শ্রেষ্ঠত্ব ও তার বিস্ময়কর অথচ কৃতিত্বপূর্ণ অবদান বোঝাতে লেখক এ গ্রন্থে জাহেলী যুগ অর্থাৎ সর্বশেষ নবী ও রাসূল হযরত মুহাম্মদ (সা) এর আর্বিভাবের পূর্বে পৃথিবীর অবস্থা - ধর্মীয়, নৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবেশের চিত্র তুলে ধরেছেন। জাহেলী যুগ সম্পর্কে প্রয়োজনীয় এবং বিভিন্ন দুষ্প্রাপ্য তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপনের মাধ্যমে গ্রন্থটি সমৃদ্ধ করেছেন। এ গ্রন্থের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য বিষয় হচ্ছে রাসূল (সা) এর আর্বিভাবের প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া এবং ইসলামী দাওয়াতের বৈশিষ্ট্যসমূহ- দাওয়াতের মেযাজ ও এর কর্মপন্থা, নবী-রাসূলগণ কিভাবে অধঃপতিত পৃথিবীর সংস্কার ও সংশোধন করতেন, দাওয়াতের ধরণ, দাওয়াতের প্রতিক্রিয়া, দাওয়াতের মুকাবিলায় জাহেলিয়াতের অবস্থান, নবী-রাসূলগণের তাঁদের অনুসারীদের প্রশিক্ষণ দান, তাঁদের দাওয়াতের বিজয় লাভ ও এর প্রভাব-প্রতিক্রিয়া এবং পরিণতি - সম্পর্কে বর্ণনা।

লেখক এ গ্রন্থে মুসলমানদের অধঃপতন, দুনিয়ার নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব থেকে সরে যাবার কারণে মানবজাতির কী ক্ষতি হয়েছে তা চিহ্নিত করেছেন এবং দেখিয়েছেন পৃথিবীর মানচিত্রে এবং সমস্ত জাতিগোষ্ঠীর মাঝে মুসলিমদের অবস্থানগত মর্যাদা। বিশ্ব নেতৃত্ব থেকে মুসলমানদের সরে যাওয়া শুধুমাত্র তাদের জন্যেই জাতীয় দুর্ঘটনা নয় বরং লেখক ''এটাকে সর্বব্যাপী বড় দুর্ঘটনা এবং মানবতার জন্য বড় দুর্ভাগ্য'' বলে অভিহিত করেছেন। আবার, বিশ্ব নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব থেকে মুসলমানদের সরে যাওয়াকে লেখক 'ক্ষমাহীন অপরাধ' বলেও আখ্যা দিয়েছেন।

মুসলমানদের অধঃপতন মূলতঃ ইসলামী দাওয়াতের ক্ষেত্রে তাদের সীমাহীন গাফিলতি ও শৈথিল্য প্রদর্শনের পরিণতি। ইসলামী পুনর্জাগরণের জন্য লেখক প্রয়োজন মনে করেছেন- মুসলিম উম্মাহর নিজেদের মধ্যে আস্থা, ইসলামী প্রাণসত্তার দিকে প্রত্যাবর্তনের আবেগ, কর্মস্পৃহা ও প্রেরণা সৃষ্টি এবং হারানো মর্যাদার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া যে, তারা দুনিয়াকে নতুন করে গড়ার গুরুত্বপূর্ণ এবং পবিত্র কাজে অত্যন্ত কার্যকর ও সক্রিয় উপাদান, আর্ন্তজাতিক ও বিশ্ব নেতৃত্ব গ্রহণের অধিকারী এবং সমগ্র সভ্য জগতের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম।

অতঃপর, লেখক মানবজাতির কল্যাণের জন্য ইসলামী পুনর্জাগরণের অপরিহার্যতা তুলে ধরেছেন। লেখক এ গ্রন্থের মাধ্যমে সমগ্র মানবজাতিকে অবহিত করার প্রয়াস পেয়েছেন যে, বিশ্বব্যাপী বড় রকমের কল্যাণকর পরিবর্তন করতে হলে দুনিয়ার নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব শুধুমাত্র আল্লাহভীরু মুসলমানদের হাতেই তুলে দিতে হবে। এক্ষেত্রে, লেখক যুক্তি উপস্থাপন করেছেন যে, মুসলমানদের রয়েছে আল্লাহ ও তাঁর নবী-রাসূলগণের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস, নবী-রাসূলগণের দেয়া শিক্ষা, হিদায়াতের আলো ও দিক-নির্দেশনা এবং তাদের কাছে রয়েছে জীবন ব্যবস্থা হিসেবে পূর্ণাঙ্গ ঐশীবাণী।

গ্রন্থ রচনায় লেখক কুরআনের পর্যাপ্ত আয়াত, হাদীস, ঐতিহাসিক ঘটনাসমূহ এবং বিভিন্ন মনীষীদের উক্তির উল্লেখ করেছেন। এ গ্রন্থ সম্পর্কে মিসরের খ্যাতিমান সাহিত্যিক ও ইসলামী চিন্তাবিদ সাইয়েদ কুতুব (র) বলেন- ‍‌‍‌''এই গ্রন্থের গতিময়, প্রাণময় ও আবেগময় ভাষা এবং উপস্থাপনায় পাঠকের মন আলোড়িত হয় ঠিকই, কিন্তু বল্গাহারা হয় না। কোন অপ্রীতিকর সাম্প্রদায়িকতাও এখানে পাঠকের মনকে কলুষিত করে না, বরং তথ্য ও তত্ত্বভিত্তিক যুক্তির মাধ্যমে এ গ্রন্থের উদ্দেশ্য ও আবেদনকে অত্যন্ত বর্ণিল ভংগীতে চমৎকার উপস্থাপনায় এবং অত্যন্ত হৃদয়-নন্দিত করে পাঠকের আবেগ-অনুভূতি ও সেই বিচার-বুদ্ধির কাছে পরিবেশন করা হয়েছে। কোন অস্পষ্টতা নেই, কোন প্রচ্ছন্নতা নেই, নেই কথায় কথায় কোন দ্বন্দ্বও। তাই কোন চাপাচাপি ছাড়াই, অথচ ঠিক লেখকের ইচ্ছে মতই পাঠককে সিদ্ধান্ত নিতে একটুও বেগ পেতে হয় না। এটাই এ গ্রন্থের প্রধান বৈশিষ্ট্য।''

''মা-যা খাসিরাল আ'লামু বিনহিতাতিল মুসলিমীন'' গ্রন্থটি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ হিসেবে সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয় মিসরে। পরবর্তীতে উর্দু, ইংরেজীসহ বিভিন্ন ভাষায় এর অনুবাদ প্রকাশিত হয়। বাংলা ভাষায় সর্বপ্রথম গ্রন্থটির অনুবাদ প্রকাশ করে মুহাম্মদ ব্রাদার্স। গ্রন্থটির বাংলা নামকরণ করা হয়েছে ''মুসলমানদের পতনে বিশ্ব কী হারালো?''


সাঈদুর রহমান
প্রথম প্রকাশ: সভ্যতা ও সংস্কৃতি, আলোকিত বাংলাদেশ
(১৪ নভেম্বর ২০১৬)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন